1 min read

আমার দেখা তিনটি মৃত্যু!!!

আজো আমার মনে আছে। দিনটা ছিল ১লা জুন। আজকেও প্রতিদিনের মত মা ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন। আমিও জেগেছিলাম কিন্তু বিছানা থেকে ওঠা হয় নি।

Md. Omar khan

মা বললেন তাড়াতাড়ি উঠো না হয় তোমার আগে সূর্যমামা ওঠে “ফার্স্ট” হয়ে যাবে।

এটা বলে মা বিছানা থেকে আমাকে সোজা কোলে তুলে হাতে ব্রাশ ধরিয়ে দিলেন।

আমি আম্মুর কোলের মধ্যেই ব্রাশ করছি আর আমার কিছু টুথপেষ্ট মায়ের শাড়িতে আর কিছু মাটিতে ফেলতেছি।

মা আমাকে কোলে করে নিয়ে ওয়াশ রুমের ট্যাপ ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে দিলেন। আর পেছনে ঝুলানো শাড়ির আঁচলটা টেনে আমার মুখটা মুছে দিলেন।

মা আর আমি ওয়াশ রুম থেকে ড্রয়িং রুমে আসি বাবা নামাজ পড়ে তসবি পড়তেছে।

বাবার জায়নামাজের সাথে আড়াআড়ি করে মায়ের জায়নামাজটি বিছিয়ে আমাকে নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন মা।

আমি প্রথমে মাকে অনুসরণ করে হাত বাঁধি। এরপর হাত ছেড়ে দিয়ে মায়ের সিজদাহর জায়গায় দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসতেছিলাম।

আর বাবা বসা থেকে হাত দুটো লম্বা করে আমাকে টেনে আবার দাঁড় করিয়ে দেন নামাজের মত।

মা আর আমি নামাজ শেষ করলে বাবাসহ প্রতিদিন আমরা এক সাথে হাত তুলে দোয়া করি।

আজকেও বাবাসহ একসাথে হাত তুললাম। বাবা আজকে হাত তুলে দোয়া করলেন ঠিক এভাবেই,
” হে আল্লাহ, আমার স্ত্রী-সন্তানকে হেফাজত করুণ। সর্বাস্থায় তোমার উপর অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে যেন সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করতে পারেন। আমিন…

জায়নামাজ থেকে উঠে বাবা ব্যাড রুমে যেতে যেতে মাকে বললেন হালকা নাস্তা রেডি করো অফিসে যেতে হবে।

মা চেহারাটা মলিন করে বাবার উদ্দেশ্যে বললেন। আজ তোমার ছেলের জন্মদিন একটা দিন কি ছুটি করা যায় না?

এবার মায়ের উদ্দেশ্যে বাবা, সুমি ১৭ বছরের কর্মজীবনে আমি কখনো ছুটি করি নাই। আজকে কি ১৭ বছরের রেকর্ডটা ভেঙে ফেলবো?

—মা: না। আমি জানি আপনি একজন দায়িত্বপরায়ন অফিসার আমি কখনো সেটা বলছি না।

কিন্তু আজ কেন জানি আপনাকে যেতে দিতে মন চাচ্ছে না। তাছাড়া আজ আমাদের খোকার ৫ম তম জন্মদিন। যদি আজকের সময়টা দুজন মিলে খোকাকে দিই।

হয়তো ভবিষ্যৎ জীবন ওর জন্য স্বরণীয় ও শিক্ষনীয় হতে পারতো।

মায়ের কথা শুনে, একটা বড় নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বেদনা মাথা একটা হাসি দিয়ে।

—বাবা: আচ্ছা সুমি কথা দিচ্ছি আজ দুপুর বেলাতেই বাড়ি ফিরবো। ইনশাআল্লাহ

এই বলে বাবা অফিসের জন্য রেড়ি হচ্ছেন আর মা নাস্তা রেড়ি করতে গেলেন। আর আমি বাবার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।

—আমি: আচ্ছা বাবা আজ অফিসে না গেলে কি হয়?
—বাবা: অফিসে না গেলে তো তোমার জন্য খেলনা আনতে পারবো না। তোমার পছন্দের মিষ্টি আনতে পারবো না।

—আমি: আমার তো অনেক খেলনা আছে। মিষ্টি না হয় আজ খাবো না।

—বাবা: আজকে তোমার ৫তম জন্মদিন। বড় একটা ক্যাক আনব। আর অনেক খেলনা আনব।

—আমি: ঠিক আছে যাও। তবে তাড়াতাড়ি ফিরবে। দুপুরে একসাথে খাবো আর রাতে ক্যাক কাটব।

বাবা দু’হাত আমার গালের ২ পেশির সাথে লাগিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল নিশ্চয়ই।

—মা: নাস্তা রেড়ি করছি, আসুন নাস্তা করে নেন।

মা-বাবা ২ জন মুখোমুখি করে চেয়ারে বসলো। আমি বাবার পাশে দাঁড়িয়েছি। কারণ আমি চেয়ারে বসলে টেবিলে ভালো করে খেতে পারি না।

নাস্তা করে বাবা প্রতিদিনের মত আমাকে কোলে নিয়ে গেইট পর্যন্ত যান, আর মাকেও প্রতিদিনের মত কপালে চুমু দিয়ে বললেন-
প্রমিজ করলাম। দুপুরে এক সাথে খাবো। এবার একটু হাসি দাও,
—-মা: (হাসি মুখে) আল্লাহ যেন নিরাপদে বাসায় আনে।

গেইট থেকে প্রতিদিনের মত বাবাকে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফিরে আসেনি মা। দু’চোখে দেখেই রয়েছে মা, আর বাবা একটু পরপর পেছন দিকে ফিরে ফিরে দেখছে আর হাতের ইশারায় বলছে বাসায় চলে আসার জন্য।
তবুও আসি নাই। যতক্ষণ বাবাকে দেখা যাচ্ছিল ততক্ষণই দেখে রইলেন বাবাকে।

বাসায় ফিরে আমি গলির মধ্যে সাইকেলিং করতেছি সামনের রুম থেকে পেছনের রুম পর্যন্ত।

আর মা ব্যাড রুম গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলতেছে আমার সাথে।

—আমি: মা, আজকে দুপুরে কি বাবার সাথে খাবো?
—- মা: হুমম বাবা। আজকে বাবার সাথে খাবে।
—- আমি : তাহলে আজ বেশি করে রান্না করো মা।
—- মা: অবশ্যই করবো।
—–আমি : আচ্ছা মা, আজকে তো আমার জন্মদিন বাবা তো ক্যাক আনবে, খেলনা আনবে, তুমি কিছু গীপ্ট করবে না?
—- মা: করবো তো। অনেক দিবো।
—– আমি: কখন দিবে? বাবা তো দুপুরে নিয়ে আসবে।
—– মা: তোর বাবা দুপুরে আসলে বাবাকে নিয়ে শপিং মলে যাবো। যা চাও নিয়ে দিবো। আর রাতে পার্টি করবো।
—- আমি: সত্যি? তাহলে তো অনেক মজা হবে।

এরপর কিছুক্ষণ সাইকেলিং করে ব্যাড রুমে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে ছোটদের ইসলামী সংগীত দেখতেছি।
দেখতে দেখতে ঘুম চলে আসলো।

ঘুম থেকে জেগে মাকে জিজ্ঞেস করলাম। —–আমি : মা দুপুর হতে আর কতক্ষণ?
—– মা: কেন বাবা? এখন তো দুপুর।
——আমি: বাবা না আজ দুপুরে আসার কথা। আসে নি?
——মা: না আসেনি। হয়তো আসার পথে।

এবার মা হাত দুটো আমার দিকে টেনে দিয়ে বলল এসো গোসল করিয়া দেই। ততক্ষণেই বাবা এসে পড়বে।

মায়ের সাথে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে আসলাম। তখনও বাবা আসে নি।

সময় তখন ২ টার কাটা অতিক্রম করে ৩ টার কাটা ছুঁই ছুঁই।

——আমি: মা আমার অনেক খিদে পেয়েছে। বাবা কি আসবে না?
—–মা: আসবে আর একটু অপেক্ষা করো এক সাথে খাবো।

এই বলে মা আর আমি গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে রইলাম বাবা আসার পথটার দিকে।

দুপুর পেরিয়ে বিকেল। আর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা। এখনও বাবা ফেরেনি।

বিকেল থেকে মায়ের মুখ থেকে হাসিটা বিদায় নিয়েছে। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি মায়ের প্রতি সেকেন্ড পর পর মানসিক অবস্থার অবনতি ঘঠছে।

—–আমি: (মাকে) বাবা কি আমার জন্য শপিং করতে গেছে?
—– মা : জানি না বাবা, হয় তো।
——- আমি: মা তুমি ওই রকম মুখ করে রাখছো কেন? আমার কান্না পাই তুমি না হাসলে।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আবেগের বশত অনেক কেঁদেছে।

আজ অনেক ১২ টা বছর পেরিয়ে গেছে। আজো বাবা আমার জন্য জন্মদিনের ক্যাক নিয়ে ফিরে আসেনি।

ফিরে এসেছে বাবার রক্তাক্ত সাদা শার্টটি ফিরে এসেছে বাবার রক্তাক্ত সাদা গেঞ্জিটি ফিরে এসেছে বাবার রক্তাক্ত একটি মাত্র জুতো আর ফিরে এসেছে বাবার মৃত দেহটি

আজ মা গেইট পর্যন্ত গিয়ে বাবার পরিবর্তে আমাকে বিদায় জানায় কলেজের উদ্দেশ্যে

অবসরে আজ আর বাবার জন্য মায়ের ভালোবাসার কবিতা লিখা হয় না রোমান্টিক কোনো গান রিহার্সাল করে না
অবসরটা সত্যিই মায়ের জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে ১২ টা বছর ধরে।

আজ মা প্রাইভেট, টিউশন নিয়ে ভিষণ ব্যস্ত মায়ের অর্জিত টিউশনের টাকা দিয়ে আজ আমি “সরকারি হাজী মুহাম্মাদ মহসিন কলেজ” চট্টগ্রাম এর এইচএসসি ২য় বর্ষের ছাত্র।

সামনে আমার এইচ.এস.সি পরীক্ষা। তাই মা দুরে গিয়ে টিউশন করেন না আমাকে সময় দেওয়ার জন্য।

মায়ের জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হলো আমাকে দেশে সেরা ডাক্তারের আসনে দেখা। আমি যেন মানবতার ডাক্তার হই।

আমি যেন পথশিশুদের ডাক্তার হই। আমি যেন হই সেই সব মানুষের ( মধ্যভিত্ত) ডাক্তার যারা টাকার জন্য ভালো চিকিৎসা পাই না।

আবার সামাজিকভাবে আত্মসম্মানের উপর আঘাত আসবে তার ভয়ে কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারে না।

আম্মুর বেশির ভাগ স্টুডেন্ট ৪/৫ বছর ধরে পড়ছেন এরই সুবাদে স্টুডেন্টদের অভিভাবকদের বুৃঝিয়ে বলাতে ওনারা আমাদের ঘরে এসে পড়াতে রাজি হন।

আবার কিছু স্টুডেন্ট চলেও যায় অন্য শিক্ষকের কাছে।

আমার পরীক্ষার মাত্র ২ টা দিন বাকি। নাস্তা করে সকাল ১০ টার দিকে বের হই মা আর আমি।

উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করবো আর কলেজ থেকে প্রবেশপত্রটা নিয়ে ফিরবো।

সময় তখন ১২ টা বেজে ১৮ মিনিট। কলেজের প্রশাসনিক ভবন থেকে প্রবেশপথ নিয়ে বের হয়ে কলেজের গেইটের সামনে আসতেই আমার বুকটা কেমন জানি কেঁপে উঠল কোনো কারণ ছাড়াই।

আমার বাম হাতে ছিল ফাইল। তার ভিতর প্রবেশপত্র সহ কয়েকটা কলম, রাবার, আর পেন্সিল।

আর ডান হাতে মায়ের বাম হাত ধরা।
যাত্রা হলো আমাদের কলেজ ( সরকারি হাজী মুহাম্মাদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম) গেইট হতে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের গেইটের ওই পাশে যাওয়া।

কলেজ গেইট হতে সামনের দিকে যতই পা বাড়াচ্ছি ততই আমার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠতেছে আর চোখগুলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।

কলেজ গেইট হতে সামনে ঠিক ৪ টা পা বাড়াতেই উত্তর দিক থেকে আসে ৬ নং মিনি বাস (মদুনাঘাট-মার্কেট), মা অনেকবার হাত উঠিয়ে সর্তকত করছিল গতি কমানোর জন্য।

কিন্তু মরণঘাতী মিনি বাস শুনে নি মায়ের কথা। প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় মায়ের দেহটাকে।

কিছু বুঝে ওটার আগেই মায়ের রক্তে রঞ্জিত হয় পিস ডালা পথটা আর সেই সাথে আমার প্রাণের ক্যাম্পাস, সরকারি হাজী মুহাম্মাদ মহসিন কলেজ এর গেইটটা।

আজ ১০ টা বছর হয়ে গেলো আজ অব্দি সেই গেইট লাল। মনে হয় আজো সেই লাল গেইটে মিশে আছে আমার মায়ের তাজা রক্ত।

মায়ের মৃত্যুর পর আমি যেভাবে ভেঙে পড়েছি। সেটা কেটে উঠতে আমার অনেক সময় লেগেছিলো।

সেই সময়টাতে আমার বন্ধুরা আমাকে যথেষ্ট মানসিক সাপোর্ট দিয়েছিল। আজো তাদের ভুলে যাই নি।

আনিকা, মল্লিক, ফাহাদ, ফারাহ, মুনা, শামীম, শাহারিয়া তানজিনা তোদের মানসিক সাপোর্ট না পেলে হয়তো আজ এতো দুর আসা হতো না।

অনেক ব্যথা আর মা হারানোর তিক্ত বেদনা নিয়ে রোজ রোজ টেবিলে বসতে হয়। পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রায়ই মায়ের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসত, লিখার জন্য ভুলে যেতাম, পরক্ষণে মনে পড়ে আমি পরীক্ষার হলে তখনই আবার লিখা শুরু করি।

আমার ঐ সময়ের কষ্টগুলো একমাত্র সেই বুঝতে পারবে, যে কিনা ৫ বছর বয়সে বাবাকে আর ফাইনাল পরীক্ষার ২ দিন আগে মাকে হারিয়েছেন।

কোনো রকম পরীক্ষাটা দিলাম। পরীক্ষা শেষ করে বন্ধুরা মায়ের সাথে সময় কাটাচ্ছে আর আমি মায়ের স্মৃতিগুলো নিয়ে।

বাবার রক্তাক্ত সাদা শার্ট আর মায়ের রক্তাক্ত সাদা শাড়ী যেমন ছিল অত্যন্ত বেদনার তেমনি প্রেরণারও ছিল।

বাবার রক্তাক্ত সাদা শার্ট দেখলে মনে পড়ে মায়ের কষ্টের দিনগুলো আর মায়ের রক্তাক্ত সাদা শাড়ী দেখলে মনে পড়ে আমাকে ঘিরে মায়ের স্বপ্নগুলো।

পড়াশোনার ইচ্ছে মোটেও ছিল না। কিন্তু মায়ের কথা গুলো আমাকে পড়াশোনা করতে বাধ্য করলো।

পড়াশোনা না করলে তো মায়ের সাথে প্রতারণা করা হবে। তাই কয়েকজন বন্ধু আর মেডিকেল পড়ুয়া বড় ভাইদের কাছ থেকে পরামর্শ নিলাম।

ওনাদের কথা মত পরীক্ষার কয়েকদিন পর আমি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী “রেটিনা মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার” অফিসে যাই।
সেখানে গিয়ে ওনাদের কথা মত সব ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে বাসায় ফিরে যাই।

নির্দিষ্ট তারিখে ক্লাস শুরু হলো। মনের মধ্যে বড় ধরনের ক্ষত নিয়েও যথেষ্ট চেষ্টা করছি ক্লাসগুলো করার জন্য।

কোচিং-এ ক্লাস করতে করতে একদিন এইচ.এস.সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো।
আলহামদুলিল্লাহ এসএসসির মতো গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছি।

রেজাল্ট পেয়ে নিজের উপর কনফিডেন্স বেড়ে
গেলো। নতুনভাবে লক্ষ্য স্থির করে আবারো শুরু করলাম পড়াশোনা।

সময় বাঁচানোর জন্য বাসায় রান্না করতাম না। কোচিং থেকে আসার সময় রেস্টুরেন্ট থেকে রোজ রোজ খাবার নিয়ে এসে ফ্রিজে রাখতাম পরে সময় মত গরম দিয়ে খেয়ে নিতাম।

এভাবে টানা কয়েক মাস পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের রাতে মাকে ভিষণ মিস করছি। খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। আবার ভোরে উঠে নামাজ পড়ে কোচিং এর লেকচার শীটগুলো রিভিশন করছি।

সময় হাতে নিয়ে, রেডি হয়ে বের হলাম। আল্লাহর উপর ভরসা করে হলে ঢুকলাম। আমার সীট ছিলো টেবিলের তিন সারির মধ্যের সারির ২য় বেঞ্চে।

পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে সোজা বাসায় চলে এসে গেলাম। অযু করে নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসলাম। এরপর বসা থেকে হাত টেনে ফাইল থেকে প্রশ্নটা নিলাম।

ততক্ষণই কোচিং থেকে এক বড় ভাইয়ের ফোন। রিসিভ করে কৌশলাদি বিনিময়ের পর।

—- কয়টা হয়েছে?
—– ভাইয়া, প্রশ্ন হলে দেখছি আর দেখি নাই।
এরপর প্রশ্নটা নিয়ে আমি যেগুলো উত্তর দিছি ওগুলো দাগ দিয়ে ভাইয়াকে মেসেজ পাঠালাম।

৫ মিনিট পর ভাইয়া আবার কল করে বললেন
—— তুমি কি আমাকে যেভাবে বলছো ঠিকঠাক সেগুলো উত্তর দিছো?
—— জ্বি ভাইয়া। আমি ওই আপশন গুলোই উত্তর লিখছি।
——- সেরকম যদি হয়, তুমি জাতীয় মেধায় ৫ জনের ১ জন হবে। ইনশাআল্লাহ ।
এটা আমার বিশ্বাস।

কথাটা শুনার পর আমি আর কিছু বলতে পারি নি। হয়তো আবেগের কারণে।

যাই হোক রেজাল্ট এর জন্য অপেক্ষা করতে করতে রেজাল্টের দিনটাও চলে আসলো। সকাল থেকে কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগছে।

সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সময়গুলো খুবই অস্থির লাগছিল। এরপর জোহরের নামাজের পর সুরা আর-রহমান তিলাওয়াত করতেছিলাম সেই সময় ভাইয়ার কল।

কল রিসিভ করতে অনেক ভয় লাগছিল। পরে আবার রিসিভ করতেই, ভাইয়া জোরে একটা ইংরেজি ওয়ার্ড বলছিল Congratulation!!!
এরপর বললেন আমি এক্ষুনি তোমার বাসায় আসতেছি।

আমি রেজাল্ট দেখার জন্য কয়েকবার মোবাইলে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। কারণ সার্ভার সমস্যা করতেছিল।

পরে মোবাইল রেখে ২ রাকাত শুকরিয়া আদায় করতঃ নামাজ পড়লাম। এটা ছিল মাকে অনুসরণ……

জায়নামাজে থাকা অবস্থায় ভাইয়া এবং কোচিং এর পরিচালকসহ ৪ জন আসলেন। আমি ওনাদের দেখে “থ” হয়ে গেলাম।

আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে কয়েকটা ছবি নিলেন। পরে মিষ্টি মুখ করে কিছু পরামর্শ দিয়ে বিদায় নিচ্ছেন ঐ সময় ভাইয়াকে বলল:

——- আমি: ভাইয়া আমার পজিশন কত?
কথাটা ভাইয়াকে বললেও সবাই জোরে জোরে হাসতে লাগলেন।
আর বললেন তুমি জাতীয় মেধায় ১ম হয়েছো।
আমি একেবারেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

যাই হোক ভাইয়াদের বিদায় জানিয়ে হালকা করে লাঞ্চ করে বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতেছিলাম যারা কোচিং-এ পড়তো।

কিন্তু কারো সাথে যোগাযোগ হয় নি। ৪ জন বন্ধুর নাম্বার ছিলো ৩ টাই অফ।

ঐ দিন আর বাসা থেকে বের হয় নি। অনেক খুশি লাগছিল কারণ আমার উদ্দেশ্যে ছিল মেডিকেলে চান্স পাওয়া।

আজ মা থাকলে আরো বেশি খুশি লাগতো। মা জড়িয়ে ধরে একটু আদর করতো। যাই হোক আম্মু না থাকলেও আম্মুর স্বপ্নটা তো পূরণ করতে পারবো। ইনশাল্লাহ

পরের দিন সকাল বেলা কোচিং-এর ভাইয়ারা যেতে বলছিলো। আমি বাসা থেকে বের হয়ে চকবাজার অব্দি যেতে না রাস্তায় কিছু কলেজ পড়ুয়া স্টুডেন্টস আর কিছু মানুষ আমার দিকে কেমন করে যেন চেয়ে আছেন।

নিজের মধ্যেও কেমন জানি ভয় কাজ করছিল। তারপরেও আমি সামনে চলছি। প্যারেড মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোনায় যেতেই সামনে বড় একটা পোস্টারের দিকে আমার চোখ যায়।

ওই পোস্টারে গতকাল ভাইয়ারা যে ছবি তোলেছিল ওই ছবিগুলো আর জাতীয় মেধায় ১ম স্থান ছিল আমার নামের পাশে।

পরে ভাইয়াদের পরামর্শ মত ভর্তি হই ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ভর্তি হওয়ার সময় কোচিং-এর ভাইয়ারা সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন।

আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে। আমার ক্যাম্পাসের ( ঢাকা মেডিকেল কলেজ ) পাশে ১ টা টিউশনের ব্যবস্থা করে দেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আওয়াল স্যার। স্যারের বন্ধুর মেয়ে।

ছাত্রীর নাম মারিয়া তাসকিন (মাহি)। সবাই মাহি বলে ডাকতো। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।

প্রথম দিকে Biology, Chemistry তে একটু কাঁচা থাকলেও পরবর্তী মাহির নিরলস পরিশ্রমে এতই উন্নত হয়েছে যে, আমি অবাক হয়ে যেতাম।

আমার লাইফে এমন ভদ্র আর পরিশ্রমী ছাত্রী খুব কমই দেখছি। ভদ্র বললাম এই জন্য যে বিগত ৮ মাস পযর্ন্ত আমি মাহিকে পড়াই। এই সময়টাতে আমি কখনো মাহির মাথার চুল পর্যন্ত দেখি নাই।

মাহির মূখে সবসময় আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, তাবারাকাল্লাহ, শুকরিয়া, জাজাকাল্লাহ খাইরান এই শব্দ গুলোর চর্চা ছিল।

অথচ ঢাকা শহরের বেড়ে উঠা একটি মেয়ে। আর অান্টি আনকেল যথেষ্ট পরিমাণ স্নেহ করতেন। আন্টি তখন অব্দি আমার সামনে আসেন নি।

আনকেল আমার স্যারের বন্ধু হওয়ার সুবাদে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন। একদিন পড়া শেষে বেরিয়ে যাবো ওই সময় আনকেলঃ

—— যদি তাড়া না থাকে তাহলে ৫ মিনিট কথা বলা যায়?
……. জ্বী আনকেল সমস্যা নেই।

আমি মনে মনে ভাবতেছি টিউশনটা বোধ হয় আজকেই শেষ!!!

——- আনকেল: তোমার স্যারের কাছে তোমার সম্পর্কে জেনেছি, তোমার অান্টিও তোমার যথেষ্ট প্রশংসা করে। মাহির পড়াশোনাও আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে।

তো যদি কিছু মনে না করো, তোমার ক্যাম্পাস ও দুরে না তাই বলছি আমাদের সাথে আমাদের বাসায় উঠে যাও।

ভিতর থেকে সামনে এনে আন্টি,
—– হ্যাঁ। এসে যাও আমি তোমার মায়ের মত একজন। আর মাহি তোমার বোনের মত। দু’জন মিলে পড়াশোনা করবে।

আন্টিকে এর আগে কখনোই সামনে আসতে দেখিনি। আন্টি সামনে আসতেই আমি চোখ নিচু করে নিই।

আন্টি আনকেল এর কথা শুনে আমি রাজি হয়ে বাসায় উঠে যাই।

মাহিদের বাসায় আসার পর মাহিকে ১ ঘণ্টা করে সময় দিতাম। এরপর মাহি ওর রুমে পড়তো আমি আমার রুমে পড়তাম।

এভাবে এইচএসসি এর পর মাহিকে রেটিনাতে ভর্তি করিয়ে দিই। এই বছর থেকে আমিও রেটিনাতে ক্লাস নিই। কোচিং থেকে এসে মাহিকে বাসায় দেখতাম আরো ১ ঘণ্টা।

অবশেষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় মাহি জাতীয় মেধায় ৭ম হয়।

সময়টা রমজানের কিছুদিন পর আমি ফাইনাল ইয়ারে।
ওই সময় একদিন স্যার ( আব্দুল্লাহ আওয়াল) ওনার স্ত্রীসহ আনকেলদের বাসায় আসলেন।

গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে আমার সাথে মাহির বিয়ের কথা বলতে শুরু করেন।

এরপর ম্যাডম ( স্যারের স্ত্রী) আমার রুমে নিয়ে জানতে চাইলেন আমার কিছু বলার আছে কিনা।

—- আমি: না ম্যাম, মাহি আর আন্টিদের যদি সম্মত থাকে আমার কোনো সমস্যা নেই।

পরবর্তী ১ সপ্তাহের মধ্যে আমাদের বিয়ে হয়।

বিয়ের পর আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া আদায় করে বলতাম।

আল্লাহ জানিনা আমার কোন কাজের বিনিময়ে আমাকে মাহির মত একজন আধুনিক অথচ দ্বীনদার নারী উপহার দিয়েছো।

যাকে (মাহিকে) বড় হওয়ার পর তার নিকটতম আত্মীয়দের মধ্যেও কোনো পুরুষ দেখেনি।

আমাদের বিয়ে হয় ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালের ৬ ই ফেব্রুয়ারিতে আসে আমাদের কোল জুড়ে এক কন্যা সন্তান।

২০১৪-২০২০ সালে পর্যন্ত ৬ বছরের সংসা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অত্যন্ত রোমান্টিক। দু’জন দু’জনকে ছাড়া আমরা গোসলও করিনি। এমন কোনো বর্ষা ছিল না যে বর্ষার বৃষ্টিতে একসাথে ভেজা হয় নি।

প্রতিদিন মাহির রান্না করতে গেলে আমি পেছন থেকে গিয়ে, হাত দুটো মাহির কোমরে ধরে ওর ঘাড়ে আলতো করে আদর করতাম।

পরবর্তীতে সেটা আমার দৈনিন্দন কাজে পরিণত হয়ে যায়। আমি যদি কোনো দিন পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে না ধরতাম সেই দিন মাহি অনেক রাগ করতো।

আর সেই রাগ ভাঙতে আমার অতিরিক্ত ২০ টা মিনিট জড়িয়ে ধরতে হতো।

২০১৮ সালের ১১লা মার্চ প্রাণের জন্মভূমি বাংলাদেশ আর প্রাণের শহর ঢাকা আর চট্টগ্রামকে বিদায় জানিয়ে আমরা নিউইয়র্কে চলে আসি।

নিউইয়র্কে ২ জনই একই মেডিকেলে চাকরি করি। দুজনের একই সময় ডিউটি। একই সময় ছুটি।

আমি, মাহি আর আমাদের ৪ বছরের মেয়ে আদনান মাহি (ঐশী) এই নিয়ে আমাদের পরিবার। আমাদের পৃথিবী । আমাদের স্বপ্ন ।

প্রতি সপ্তাহে ২ দিন যে ছুটি পেতাম ওই ২ দিন নিউইয়র্কের পর্যটান জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াতাম। অনেক জায়গায় আছে যেখানে ২/৩ বার সহ ঘুরাঘুরি শেষ।

৬ ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ ইং। সামনে একমাত্র মেয়ে ঐশীর জন্মদিন। অনেক স্বপ্ন ঘেরা একটা দিন হবে। কতই না স্বপ্নের কথা বলছি।

গত ২ সপ্তাহ থেকে আমরা ( আমি আর মাহি) Corona unite এ চিকিৎসা দিচ্ছি ২ জনই। চোখে মূখে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। দেশের আত্মীয় স্বজনরা বার বার কল করতেছে সচেতন থাকার জন্য।

১৯ ই জানুয়ারি মেডিকেলে যাচ্ছি ২ জন এক সাথে। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মাহি আমাকে এত শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে এর আগে কখনোই এরকম শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে দেখি নি।

এতই শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। জড়িয়ে ধরে এক অঝোর ঝরায় কান্না করছিল, যেন পৃথিবীতে ওর শেষ দিন। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলছিল। আমার মেয়েটার যত্ন নিউ।

৬ বছরের সংসার জীবনে কখনো ওর চোখে অশ্রু দেখিনি। আসতেও দিই নাই।

সেই ১৯ শে জানুয়ারি মেডিকেলে গিয়ে আর ফিরে আসে নি আমার কলিজার টুকরা মাহি। আমি ওই মেডিকেলেরই ডাক্তার তারপরেও পারি নি গ্লাসের ভিতরে গিয়ে পাগলীটার কপালে একটু চুমু দিতে।

২৭ জানুয়ারি আমার আর মেয়ের Corona test করে। ওখানে আমার মেয়েরও Corona পজিটিভ।

মেয়েকে যখন আমার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে তখন বলছিল,

Papa আমি চলে যাচ্ছি মায়ের কাছে তুমি কি আসবে না? তুমিও চলে আসো।

২ রা ফেব্রুয়ারী আমার জীবনে যে ক্ষতিটা হয়েছে। যে শূণ্যতা তৈরি হয়েছে তা পৃথিবীতে পূরণ করা কখনোই সম্ভব হবে না।

হাজারো চেষ্টা করছিলাম মাহিকে একটু স্পর্শ করতে কিন্তু পারলাম না।
তবে আমার ভাগ্য ভালো যে দাপনের সময় আমার যাওয়ার সুযোগ হলো।

মাহি তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে পাগলী। আমার আগে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিতে চাইতে। আমার কোলে মাথা রেখে মরতে না পারলেও আমার হাতে তোমাকে মাটি দেওয়া এই ইচ্ছেগুলো পূরণ হয়েছে।

আজও জানিনা আমার মেয়েটা কেমন আছে? কোন অবস্থায় আছে? বাবার কাছে আসে নাকি মায়ের কাছে যায়?

৩২ বছরের জীবনে নিজের হাতে বাবাকে কবর দিয়েছি, মাকে কবর দিয়েছি, কলিজার টুকরা হৃদয়ের পাখি, প্রিয় জীবন সঙ্গীনীকে কবর দিয়েছি। জানি না আমাকে কোন হাতে দাফন দেওয়া হয়।

হে পরম করুণাময় আল্লাহ আমার জীবন থেকে বাবাকে কেড়ে নিয়েছো, মাকে কেড়ে নিয়েছো, আজ আমার স্ত্রীকে কেড়ে নিয়েছো। তোমার কাছে ফরিয়াদ আমার মেয়েকে কেড়ে নিউ না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *