আমার অধ্যাপক বাবার গল্প (পার্ট-১)
(৩০ শে জুন ২০২১ইং) সময়টা সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ৫ মিনিট। আমার অধ্যাপক বাবা মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে পুরাতন বেতের চেয়ারটিতে বসেন।
আমি কিচেন রুম থেকে কফি হাতে নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দু’টো বাড়িয়ে দিলাম।
বাবাও সামনে হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে কফিটা নিলেন।
কফিতে প্রথম চুমক দিয়েই, আমার উদ্দেশ্যে:-
বাবা: মীম, আজাদ স্যারের ক্লাস ছিল আজ?
—- হুম বাবা ছিল। বাবা আমাকে একটু হ্যাল্প করবা?
বাবা: সিউর। কি হ্যাল্প লাগবে মা তোর?
—– বাবা আজাদ স্যার ওনার গ্রুপের 21k উপলক্ষে একটা কনটেস্টের আয়োজন করেছেন।
ওখানে আমি ছোট গল্পে পার্টিসিপেইট করবো। তো আমাকে একটা গল্প লিখতে হ্যাল্প করো।
বাবা আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে কফিতে আরো কয়েক ঢোক চুমক দিয়ে কাপটি সোপার হাতলে রেখে আমার উদ্দেশ্যে…
বাবা: মারে আমার তো লেখালেখিতে হাত নেয়। আর গল্প লিখা। এটা তো সহজ কাজ নয়।
—- বাবা আমার জন্য না হয় চেষ্টা করো।
বাবা: আচ্ছা ঠিক আছে মা, গল্প নিজেরটা বলি, নিজের জীবন থেকে কিছু বাস্তব ঘটনা আর অভিজ্ঞার কথা বলছি।
— হুম বাবা বলো।
বাবা যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবেই তোলে ধরলাম:
১৯৮১ সালের কথা। বয়সটা আমার ৫ পেরিয়েছে মাত্র। তারই মধ্যে একদিন বাবাকে হারালাম।
তারপর কিছুদিন পর নানুর বাড়িতে যায়। সেখানে থাকতাম। মাঝে মাঝে দাদু আর চাচাজি আসতেন।
প্রতিবারই আসার সময় আমার জন্য জামাকাপড় আর পেঁয়ারা, আম, পেঁপে নিয়ে আসতেন।
নানুর বাসায় যাওয়ার সম্ভবত কয়েকমাস পর ছোট মামা যে স্কুলে চাকরি করতেন সেই স্কুলে আমিও ভর্তি হই।
সকালবেলা মকতবে থেকে, এসে আবার স্কুলে যেতাম। স্কুল ছুটির পর নদীর তীরে সবাই মিলে খেলতাম।
সন্ধ্যায় ছোট মামা আমাদের কয়েকজনকে পড়াতেন। এভাবেই নানুর বাসায় ছিলাম নানা-নানু, মামা, খালামনি আর মায়ের সাথে।
একরাতে নানুর বাসায় অনেক মেহমান আসছিল, জানিনা ওনারা কারা বা কেন এসেছিলেন?
কিন্তু সেদিন রাতে খাবার খেয়ে যখন মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছিলাম। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রচণ্ড কাঁদছিলেন।
আর আমি কোনো কারণও জানতে চাই নি। কারণ মা মাঝে মাঝে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কাঁদতেন।
পরে নানুর কাছ থেকে জানতে পারলাম মা নতুন বিয়ে করছে। বিয়ের দিনও ধার্য হলো।
পরে হয়তো দাদুর বাসায় খবর দেওয়া হলো।
পরেরদিন বিকেল বেলা স্কুল থেকে এসে খেলতেছি নদীর তীরে। ছোট নানু আমাকে ডাকতে যান।
বাসায় এসে দেখি চাচাজি আসছেন, আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
মা আমাকে সাবান দিয়ে হাত-মূখ পরিষ্কার করে দেন। পরে নতুন জামা আর জুতো পড়িয়ে দেন।
মা আগে থেকেই আমার ব্যাগ গুছিয়ে রাখেন। ব্যাগটি হতে নিয়ে চাচাজি ঘর থেকে বের হলেন।
মা, নানু, খালামনিরা জড়িয়ে ধরেন শেষ বারের মত।
ট্যাক্সিতে করে চলে আসলাম দাদুর বাসায়। কয়েকদিন পর শুনলাম মা নতুন শশুরবাড়িতে চলে গেছেন।
আমাকে চাচাজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। স্কুলে আসা যাওয়া দাদু, চাচাজি সবার আদরে কয়েকমাস কেটে গেলো।
এরপর শীতকালীন ছুটিতে নানুর বাড়ি থেকে খবর দিলো মা আসছে, আমাকে যেন একটু নিয়ে যায়।
দাদু আর চাচাজির সাথে আমি গেলাম। অনেকদিন পর মাকে দেখলাম। ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম আমি মায়ের কাছে যেতে।
তবে কারো কাপড়ের আড়ালে, দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে বার বার মাকে দেখছিলাম।
নানুর বাড়ি থেকে ঐদিন কয়েক ঘণ্টা পর চলে আসলাম দাদার বাড়িতে।
ঐ দিন ছিল মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা।
মাঝে মাঝে আম্মুর জন্য খুব মন কাঁদত, মাকে দেখার জন্য, মায়ের আদর পাওয়া জন্য খুবই ইচ্ছে করতো।
কিন্ত সেই ইচ্ছের কথা কখনো দাদু, চাচাজি কাউকে বলা হয় নি। আর মা তো নতুন সংসার নিয়ে ভীষন আছেন।
দিনের পর মাস আর মাসের পর বছর যেতে থাকে। এভাবে আমিও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন চান্স পাই, সেদিন মাকে খবর দিই। শুনেছি মা নাকি ভীষণ খুশি হয়েছেন।
(চলবে)